পশ্চিমতীরের মানচিত্রের দিকে তাকালে জেরুজালেমের ঠিক দক্ষীণে অনতিদূরে ‘বেথেলহেম’ নামক যে শহরটি চোখে পড়ে তা পবিত্র কুরআনে ‘মাকান কাসিয়্যা’ বলে উদ্ধৃত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, فَحَمَلَتْهُ فَانْتَبَذَتْ بِہٖ مَكَانًا قَصِیًّا “অতঃপর সে গর্ভে তাকে ধারণ করলেন; তারপর তা নিয়ে এক দূরবর্তী স্থানে সরে গেলেন” [আল-কুরআন, ১৯:২২]।উদ্ধৃত আয়াতটি মারইয়াম ও ঈসা (আ.) জন্মবৃত্তান্ত সংশ্লিষ্ট। পূর্বাপর আয়াত থেকে স্পষ্ট যে মারইয়াম (আ.) সন্তানের সুসংবাদে বিস্মিত হয়ে পড়েন এবং বাইতুল মুকাদ্দাস ত্যাগ করে ‘মাকান শারকিয়্যা’ তথা পূর্ব জেরুজালেমে চলে আসেন। তারপর আরও দক্ষিণ দিকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে ‘বেথেলহেম’ এলাকায় আসেন। ব্যাখ্যাকারগণের মাঝে ইমাম রাযী ও আল্লামা যামাখশারী ‘মাকান কাসিয়্যা’ বলতে মিসরকে উদ্ধৃত করেছেন [রাযী, মাফাতিহুল গাইব, খ. ৭, পৃ. ৫২৫; যামাখশারী, কাশশাফ, খ. ২, পৃ. ৫০৬]। কোনো কোনো শীআ বর্ণনায় স্থানটি কারবালার ইমাম হোসাইনের মাকবারা এলাকা উদ্ধৃত করা হয়েছে। অপর এক শীআ মতানুযায়ী তা বাগদাদের মাসজিদু বুরসা এলাকা বুঝানো হয়েছে যেখানে এমন একটি শ্বেত পাথর রয়েছে যার উপর ঈসার জন্ম হয়েছে দাবি করা হয়। কোনোরূপ সূত্র থেকে মারইয়াম (আ.) এতো দূরুত্বে সরে যাওয়ার প্রমাণিত হয় না।
ইঞ্জিলের বিভিন্ন সূত্র থেকে একদল গবেষক প্রমাণ করেছেন যে, কুরআনের ‘মাকান কাসিয়্যা’ বলে অনতিদূরের বেথেলহেম উদ্দেশ্য [বাতরূস আব্দুল মালিক, কামুস আল-কিতাব আল-মুকাদ্দাস, পৃ. ২০-২০৬]। বস্তুত মারইয়ামের (আ.) শৈশব ও কৈশর কেঁটেছিলো। আল-আকসা মসজিদের ‘মেহরাব’ নাম্বীয় কক্ষে যা বিধৃত হয়েছে পবিত্র কুরআনে। সেখানে মারইয়াম ইবাদত করতেন এবং তাঁর জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে আহার্য্য আসতো [ইমরান: ৩৭]। নবী যাকারিয়া (আ.) সে স্থানটিতে দাঁড়িয়ে একটি বিশেষ উদ্দেশে সালাত পড়েছিলেন এবং পুত্র ইয়াহইয়ার জন্ম সুসংবাদ লাভ করেছিলেন [ইমরান: ৩৯]। তারপর তিনি সে মহিমাম্বিত মেহরাব থেকে জনতার সামনে অগ্রসর হয়ে তাদের প্রাত-সন্ধ্যায় তাসবীহ পাঠের নির্দেশনা দিয়েছিলেন [মারয়াম:১১]। কুরআন এ নিয়ে এক চমৎকার দৃশ্যপট একেঁছে।তারপর মারইয়াম (আ.) পরিণত বয়সে উত্তীর্ণ হলে পূর্বদিকের নির্জন স্থানে সরে আসেন। পবিত্র কুরআনের উল্লেখিত ‘মাকান শারকিয়্যাহ’ [মারইয়াম:১৬] বলতে এ মসজিদের পূর্বদিকের কোনো এক নির্জন স্থান উদ্দেশ্য। হয়তো তিনি হায়িজজনিত কারণ কিংবা গোসল করার জন্য পানি আনতে বা নির্জনে ইবাদতমগ্ন হতে পৃথক হয়ে পড়েছিলেন [তাবারী, ১৮/১৬২; আল-রাযী, ৭/৫২০; যামাখশারী, ২/৫০৫; কুরতুবী ]। এ কারণে খ্রিস্টানরা পূর্বদিককে তাদের কিবলা করেছে এবং তারা পূর্বদিকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে [বদরুদ্দীন আইনী, উমদাতুল কারী, ১৩/৭৪]। এখানে তিনি জিবরীলকে মানুষের আকৃতিতে উপস্থিত হতে দেখেছিলেন এবং পিতাহীন ঈসার (আ.) জন্মের সুসংবাদ লাভ করেছিলেন।
তারপর স্বামীহীন নারীর সন্তান লাভের প্রেক্ষিতে পরিবার, সমাজ ও সম্প্রদায়ের সম্ভাব্য তিরস্কার, নিন্দাবাদ ও ব্যাপক দুর্ণাম থেকে রক্ষা পেতে তিনি আরও দূরবর্তী স্থানে সরে এসেছিলেন [কুরতুবী; ইবন কাসীর] যাকে কুরআন ‘মাকান কাসিয়্যাহ’ বলে উদ্ধৃত করেছে।কুরআনের একটি আয়াতে [মুমিনূন: ৫০] মারইয়াম ও ঈসার (আ.) পরবর্তী বাসস্থানটির তিনটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছে। তম্মধ্যে প্রথম বৈশিষ্ট্য ‘রাবওয়া’ যার অর্থ ‘আশেপাশের সমতল ভূমির মাঝে সুউচ্চ ভূমি’। আরেকটি বৈশিষ্ট্য বলেছে ‘যাতা কারার’ যার অর্থ এমন স্থান যেখানে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পাওয়া যায় এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন যাপন করা যায়। আর তৃতীয় বৈশিষ্ট্য “মাঈন” অর্থাৎ যে স্থানে আছে ‘নির্ঝরিণী’ রয়েছে [ইবন কাসীর]। একদল ব্যাখ্যাকার বলেছেন স্থানটি জেরুজালেমের ‘বেথেলেহেম বলে সনাক্ত করেছেন [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর; ইবন মাখলূফ আস-সালাবী, জাওয়াহির আল-হাসান, খ.২, পৃ.৪৫৩]। ফলে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, বেথেলহেম-ই ঈসার (আ.) জন্মস্থান।প্রকৃতার্থে ‘মাকান কাসিয়্যা’ যে বেথেলহেম তা অত্যন্ত পরিস্কার নবীজির (সা.) ইসরার ঘটনাতে। বর্ণনানুযায়ী বিভিন্ন স্থানে যাত্রাবিরতি ঘটিয়ে দু’রাকাত করে সালাত পড়তে হয়েছিলো। নবীজির হিজরতের স্থান তাইবা, নবী মূসার ওহী লাভের স্থান তূর সাইনা, নবী ঈসার জন্মস্থান বেথেলহেম এবং সর্বশেষ বাইতুল মুকাদ্দাস। বেথেলহেমে যে স্থানে সালাত পড়তে বলা হয় তা সম্পর্কে জিবরাঈল নবীজিকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কি জানেন কোথায় সালাত পড়ছেন? নবীজী বলেন, না। জিবরাঈল বলেন, ‘আপনি বেথেলহেমে সালাত পড়েছেন যেখানে ঈসা ইবন মারইয়াম (আ.) জন্মগ্রহণ করেছেন’ [নাসাঈ, ৪৫০]।দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাবের (রা.) সময় বেথেলহেম মুসলিম শাসনের অধীনে আসে। মারইয়ামের আশ্রয়স্থল, নবী ঈসার জন্মস্থান, নবীজির ইসরার স্মৃতি বিজড়িত এ ভূমি মুসলিমদের কাছে বিশেষ মর্যাদা লাভ করে। খলীফা ওমর (রা.) ‘চার্চ অফ ন্যাটিবিটি’ সংরক্ষণের অনুমোদন প্রদান করেন। সে ইতিহাস স্মরণে ওমরের নামে একটি মসজিদ স্থাপন করা হয়। উমাইয়া, আব্বাসীয়, আইয়ুবী ও ওসমানিয়া আমলে বেথেলহেমের ‘চার্চ অফ ন্যাটিবিটি’ অক্ষুন্ন রাখা হয়। ফাতেমীরা তা ধ্বংস করতে চেয়েছিলো, কিন্তু স্থানীয় মুসলিমরা তা প্রতিরোধ করে টিকিয়ে রাখে।
নবী ঈসার (আ.) জন্মস্থানকে সংরক্ষণ ও স্মরণীয় করে রাখতে প্রথম কনস্টিন্টাইনের মাতা হেলেন বেথেলহেম পদক্ষিণ করে ‘চার্চ অফ ন্যাটিবিটি’ তৈরি করেন। সে দিক থেকে এটি খৃষ্টান বিশ্বের ধর্মীয় তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। খৃষ্টানদের একটি অংশ নতুন করে ‘নাজরেত’ শহরকে ঈসার জন্মস্থান বলে থাকে, যা ইহুদী প্রভাবিত মত।ওল্ডটেস্টামেন্টের বর্ণনানুযায়ী বেথেলহেম ‘জোডা পাহাড়ের দেশ’ যা ‘ইফথরাথ’ নামে পরিচিত। অঞ্চলটি ‘দ্যা সিটি অব ডেবিড’ তথা নবী দাউদের শহরের অন্তর্ভূক্ত ছিলো। ইহুদীরা বেথেলহেমকে দাউদের (আ.) জন্মস্থান অনুযায়ী বিশেষ মর্যাদা দিয়ে থাকে। যদিও নবী দাউদের (আ.) মূল জন্মস্থান ‘ওয়াদী হিলবেহ’ তথা হিলবেহ উপত্যকা, বর্তমানে যা তারা পূর্বজেরুজালেমের অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছে। স্থানটি বাইতুল মুকাদ্দাস ও সিলওয়ান উপত্যকার মাঝামাঝি। সিলওয়ান উপত্যকা সে স্থান যেখানে ঈসা (আ.) একজন জন্মান্ধকে সুস্থ করে তুলেছিলেন। দখলদার জায়োনিস্টরা এখানে বসতি নির্মাণ করেছে।আরবদের কাছে ‘বাইতুল-লাহাম’ হিসেবে পরিচিতি শব্দটি ‘বাইতুল ইলাহ লেহেম’ থেকে নামটি এসেছে। বাইত মানে ‘ঘর বা গৃহ’, ইলাহ মানে গড বা প্রভু, লেহেম মানে ‘গোশত’। কিনানীয়রা ‘বাইতুল খুবয’ বা রূটির গৃহও বলতো। উর্বর ভূমি হিসেবে এলাকাটির এ নামকরণ হয়েছিলো।
বেথেলহেমের আয়তন ৬৬০ বর্গকিলোমিটার হলেও ইসরাঈলের দখলদারিত্বের কারণে মুসলিমরা মাত্র ১৩ শতাংশ এলাকা ব্যবহার করতে পারে। এরমধ্যে আবার ১৯৪৮ সনে পূর্বজেরুজালেম ও হেবরন থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা উদ্বাস্তুদের জন্য ‘আইদা, আজ্জা ও দেইসেহ’ নামক তিনটি মুসলিম রিফিউজি ক্যাম্প এবং তুকু নামে একটি খৃস্টান রিফিউজি ক্যাম্প আছে। বর্তমানে বেথেলহেম অসলো চুক্তি অনুযায়ী সি এরিয়ার আওতাভূক্ত। ফলে তার নিয়ন্ত্রণ পুরো ইসরাইলের কাছে। নগরের পূর্বে ও পশ্চিমে ৮ মিটার উচু এবং প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেপারেশন ওয়াল তৈরি করে পুরো বেথেলহেমকে একটি কারাগারে রূপান্তির করেছে। পুরো পশ্চিমতীরে এ দেয়ালের দৈর্ঘ প্রায় ৮০০ কিলোমিটার। সকালে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট চেক পয়েন্ট দিয়ে শর্তসাপেক্ষে বাহিরে আসলেও আবার সন্ধ্যার আগে নির্ধারিত সময়ে ফিরতে হয় ফিলিস্তিনিদের। ভিতরে মেষ পালন আর বাহিরে এক সময় নিজেদের হারানো জমিতে সেটেলারদের বসতি নির্মাণের কাজ করে মাইনে উপার্জন করা ফিলিস্তিনিদের প্রধান কাজ। স্থানে স্থানে রেড চেকপয়েন্ট, গ্রিন চেকপয়েন্ট, ব্লক রোড, ক্লোজড রোড গেইট ইত্যাদি শর্তসাপেক্ষ চলাচলে জীবনের স্বাভাবিকতা একেবারে রূদ্ধ। বেথেলহেমে জন্ম নেয়া একটি ফিলিস্তিনি শিশু আর চিড়িয়াখানার খাচার ভিতর জন্ম নেয়া একটি পশু শাবকের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। ফিলিস্তিনি শিশুটি বরং সার্বক্ষণিক বন্ধুকের নলের মুখে থাকছে।ইহুদীদের বিশ্বাস এখান থেকে মেসিয়া আত্মপ্রকাশ করবেন। খৃষ্টানদের বিশ্বাস যেসাস এখানে আবার আসবেন। মুসলিমদের বিশ্বাস অনুযায়ী নবী ঈসা পবিত্র ভূমি মুক্ত করবেন। এখান কেবল অপেক্ষা।পরবর্তী পর্ব “নবী ইয়াকূবের বসতি কুরআনের ‘আল-বুদু ও গায়াবাতিল জুব’ কোথায়?”
ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক
সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।