জীবনান্দ দাশ ১৮৯৯ সালে বরিশাল শহরে জন্মগ্রহন করেন।তার মাতার নাম কুসুমকুমারী দাশ, পিতার নাম সত্যানন্দ দাশ।কুসুমকুমারী দাশ ও ছিলেন একজন স্বভাবকবি। জীবনানন্দ দাশ বরিশাল ব্রজমোহন স্কুল, ব্রজমোহন কলেজ ও কলকাতার প্রেন্সিডেন্সি কলেজ এ শিক্ষালাভ করেন। ১৯৮১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্য এম. এ ডিগ্রী লাভ করেন এবং অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন।
তিনি ১৯৫৪ সালে ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন।
জীবনানন্দ দাশ বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম আধুনিক কবি। তিনি কবি হলেও উপন্যাস, প্রবন্ধ ও ছোটগল্পও লিখেছেন। তিনি অসংখ্য প্রবন্ধ, ছোটগল্প ডায়েরির লেখা প্রকাশই করেননি।
বাংলা সাহিত্যের যদি স্মরণীয় কবিতার তালিকা করা যায় তারমধ্যে জীবনানন্দ দাশের অনেক কবিতায় স্হান পাবে।জীবনানন্দ দাশ এর কবিতা ছাড়া বাংলা সাহিত্য অসম্পূর্ণ। তার মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পরেও তার কবিতা ঠিক আগের মতোই আগ্রহের সহিত পাঠ করা হয়।জীবনানন্দ একইভাবে এই শতাব্দীতেই প্রাসঙ্গিক।আজও তরুণদের মধ্যে জীবনানন্দকে পাওয়া যায়। তারা অনেকেই হয়তো জীবনানন্দ হতে চায়।
আমরা অনেকেই জীবনানন্দ এর কবিতা পড়ি কিন্তু মর্মভেদ করতে পারিনা।আমরা জানি, আধুনিক কবিতা জটিল, দূরুহ।আসলে আধুনিক কবিতা জটিল কারণ আধুনিক সময় জটিল। আর জীবনানন্দ এর কবিতা পড়তে গেলে আমাদের অবশ্যই সময়ের জ্ঞান রাখা দরকার।তার কবিতা বুঝতে তার সময়কে জানতে হবে।
কবি বলেন,
কবি হতে গেলে সমাজকে বুঝতে হবে।কবিতার অস্হির ভিতর থাকবে ইতিহাস চেতনা আর মর্মের ভিতর থাকবে সময়-জ্ঞান।
জীবনানন্দ সবসময় সময়কে প্রাধান্য দিয়েছেন।২০ শতকের সামগ্রিক জীবন বিক্ষুদ্ধ , জনজীবন বিপন্ন।কারণ প্রথম যুদ্ধের প্রভাব পড়েছিল ভালোভাবেই। ভারতবর্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহন না করলেও ব্রিটেন করে। প্রথমদিকে, ১৯১৪ সালে যুদ্ধের সময় অনেকেই কাজ পায় কারণ তখন অসংখ্য সৈনিক দরকার ছিল।কিন্তু যখন যুদ্ধ শেষ হয় ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে তখন বৃদ্ধি পেতে থাকে বেকারত্ব ও দরিদ্রতা।ব্রিটেন সরকার অনেক অর্থ যুদ্ধের সময় নিয়ে গেছিলেন ভারতবর্ষ থেকে। তাই ভারতবর্ষের অর্থনীতি নাজুক হয়ে যায়।
তারপর আবার যখন দেশভাগ করা হলো তখন, বাংলা বিভক্ত হয়ে গেল।আর এই বাংলাভাগ নিয়ে জীবনানন্দের খেদ ছিল।
আর এ সব সময়ের মধ্য দিয়েই গেছিলেন তৎকালীন লেখক ও কবিসমাজ।জীবনানন্দের কবিতায়ও এসব স্পষ্ট হয়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝতে পারি যে,জীবনানন্দ একজন সময় সচেতন কবি । তিনি লেখেছেন,
“অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ -পৃথিবীতে আজ
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশী আজ চোখে দেখে তারা,
যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই- প্রীতি নেই-করুণার আলোড়ন নেই।”
তিনি এখানে বুঝাতে চেয়েছেন পৃথিবী আজ অচল।
কবি আবার” শুকুন” কবিতায় সমাজ ও সমকালীন বিশ্বেরই প্রতিচ্ছবি আঁকেছেন।
তিনি কবিতায় লেখেছেন- “মাঠ থেকে মাঠে-মাঠে—সমস্ত দুপুর ভ’রে এশিয়ার আকাশে-আকাশে
শকুনেরা চরিতেছে; মানুষ দেখেছে হাট ঘাঁটি বস্তি; নিস্তব্ধ প্রান্তর
শকুনের; যেখানে মাঠের দৃঢ় নীরবতা দাঁড়ায়েছে আকাশের পাশে
। “এখানে তিনি বিশ্বযুদ্ধের ছবি এঁকেছেন।
কবির কাছে ছিল যুগযন্ত্রনা।
এরপর নানাঘাতে, পরিঘাতে
কবির স্বরও পরিবর্তন হয়ছে।তাই কবি বলেছেন
“নষ্ট শসা-পঁচা চালকুমড়ার ছাঁচে
সেসব হৃদয় কহিয়াছে সেইসব।”
সময় সচেনতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন ইতিহাস সচেতন কবি৷ তাই তিনি কখনোই নিজের সময়ের মধ্যে আটকে থাকেনি। তিনি তার কবিতায় আবহমানকালের ছবি এঁকেছেন।তাই যখন তিনি প্রেমের কবিতা লেখেছেন, তিনি লেখছেন,
“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিয়েছে পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকার মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি,বিম্বিসারে অশোকের ধূসর জগতে
যেখানে ছিলাম আমি,আরো দূর অন্ধকার বিদর্ভ নগরে,
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক,চারদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন
আমারে দুগন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।”
কবি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন। তাই তিনি বলেছেন,
সব ছেড়ে মানুষ ধরা দিতো স্বপ্নের হাতে তাহলে কেউ আর আঘাত পেতো না।কিন্তু যখনই তিনি স্বপ্ন দেখবো বলে চোখমেলেছেন তখনই তার চোখে রক্তের ছিটে পড়েছে,নাকে আঁষটে গন্ধ।তাই কবিতায় সুরেলিজম এর ছায়া পড়েছে।
কবি শুধু সময় জ্ঞান সম্পন্ন ছিলেন না বরং আশ্রয় খুঁজেছিলেন
তিনিই কবিতায় বলতে পেরেছিলে পাখির নীড়ের মতো চোখ। নীড়ে যেমন মানুষ আশ্রয় খুঁজে তিনিও তেমনি আশ্রয় খুঁজেছেন প্রেমিকার চোখে।
তাকে আবার অনেকেই বলেন মৃত্যু চেতনার কবি। যে কবির প্রথম কবিতা ঝরা পালক, যার দ্বিতীয় লেখা ধূসর পান্ডুলপি, যার রাতে জেগে থাকে সাতটি তারার তিমির, তার প্রিয় রং হয়তো ধূসর। সে কবি হয়তো নৈশব্দিক কবিতায়,তার কবিতায় হয়তো হাহাকার।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় শুধুমাত্র মৃত্যু জায়গা পায়নি। এরচেয়ে বেশী কিছু পেয়েছে স্হান।
তার” আট বছর আগের কথা” কবিতা পড়লে বুঝতে পারি, হঠাৎ স্ত্রীর পাশে শুয়ে থাকা মানুষটা যার সবকিছু ঠিক থাকলেও সে আত্নহত্যার কথা ভাবে।
তার “বোধ” কবিতায় তিনি বলেছেন,
“আলো অন্ধকারে যাই মাথার ভিতর
স্বপ্ন নয়-কোন একটি বোধ কাজ করে
পথে চলে পারাপারে
উপেক্ষা করতে পারিনা আমি তারে।”
কবির কবিতায় মৃত্যু চেতনার পাশাপাশি এসেছে জীবনবোধ
জীবনানন্দকে বলা হয় রূপময়তার কবি । তিনি তার কবিতায় বলেছেন,
“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপখুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছেচেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে ব’সে আছেভোরের দয়েলপাখি – চারিদিকে চেয়ে দেখি পলস্নবের সত্মূপ।”
জীবনানন্দের কাছে পৃথিবীটা এক প্রেমহীন মরুভূমি। তাই কবিতায় তিনি প্রেমের কথা বলতে গিয়ে পৌনঃপুনিকভাবে লিখেছেন অ-প্রেমের যন্ত্রণাকথা। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রবল চাপে এ-কালের মানুষের জীবন থেকে অন্তর্হিত হয়েছে প্রেম, ফলে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ দীর্ঘ নিঃসঙ্গতা।
কবির কাছে নগরজীবন বিবমিষা, বিছচ্ছিনতার প্রতিচ্ছবি। তবুও তিনি নগর জীবনকে এড়াতে পারেননি ।
কবির কবিতায় ইংরেজি কিংবা বৈশ্বিক সাহিত্যেরও প্রভাব রয়েছে। তিনি কীটস, ইটস,বদলিয়ার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।
কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রতিভাধর কবি। যার কবিতায় একদিকে যেমন মৃত্যুছায়া, অন্যদিকে তেমনই প্রবল জীবনচেতনা।তিনিই একমাত্র কবি যিনি নিস্তবতাকে উটের গ্রীবার সাথে তুলনা করতে পারেন। তিনিই প্রেমিকার চোখে নিরাপত্তা খুঁজতে পারেন।তিনিই বলতে পারেন,
“তুমি আজ মৃত্তিকা-কার প্রেম ঘাস হয়ে আসে,
সুরঞ্জনা তোমার হৃদয় আজ ঘাস।”
জীবনানন্দের কবিতাা যতবার পড়া হবে জীবনানন্দকে ততবার নতুন করে আবিষ্কার করা হবে।